কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধীর আবেগপূর্ণ এ বক্তব্যকে তৎকালীন ইউপিএ তথা মনমোহন সরকার গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে উত্থান করার। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নিতীশ কুমার রাজগীরে একশত একর জায়গার ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে ভারত সরকার সহ জাপান, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে-বিদেশের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ও ধন্যাঢ্য বক্তিবর্গ আর্থিক অনুদান দিতে এগিয়ে আসলে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে ভারত সরকার ও বিহার সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিশেষ কার্যক্রম শুরু হয়। এতে সবিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করে পাঠদানে এগিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এ. পি. জে. আব্দুল কালাম এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের কৃতিত্ব যদি দিতে হয় ড. মনমোহন সিংয়ের সরকারকেই দিতে হবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ও ভারতীয় মিডিয়ার প্রচারের মাধ্যমে নবনির্মিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যম্পাস উদ্বোধনের সাথে ভারতীয় ইতিহাসের আরেক বড় সাংস্কৃতিক দুর্নীতি ও মিথ্যা প্রচার সামনে এসেছে। বিগত ১৯ শে জুন ২০২৪ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বারা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যম্পাসের উদ্বোধনের সাথেই পরিসরে ভগবান বুদ্ধের মূর্তি সম্পূর্ণরূপে গায়েব বা বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশ ও বৌদ্ধ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আর্থিক সহযোগে বানানো হয়েছে। এককভাবে ভারত সরকারের আর্থিক দানেও নির্মিত হয়নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে ভগবান বুদ্ধের মূর্তিকেই গায়েব করা হয়েছে। অথচ পৃথিবী ব্যাপী লোকেরা জ্ঞাত রয়েছে যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদী মিডিয়া প্রচার করছে ইহা ছিল হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়।

৫০ টিরও অধিক বৌদ্ধ দেশ ও বৌদ্ধ ধনীর ব্যক্তিগণ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহযোগে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচীন ঐতিহ্যকে পুনরুত্থান ও স্মরণ করার জন্যই নব পরিসরে স্থাপন করা হয়েছে এরকম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ হতে প্রমাণ স্বরূপ যে সমস্ত বুদ্ধ মূর্তি উপলব্দ হয়েছিল, সেগুলি হতেই নতুন পরিসরে বুদ্ধ মূর্তিকে গায়েব করা হয়েছে। এতে প্রমাণ হয় যে, বিহার তথা ভারতের পরিচয় মুছে দেওয়ার সাথে সাথে ভারতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং বৌদ্ধ ঐতিহ্যকে বিলুপ্ত করার দিশায় কৃত বিহার এবং কেন্দ্র সরকারের সুপরিকল্পিত ষডযন্ত্র কাজ করছে। এমনকি ভগবান বুদ্ধের প্রধান অগ্রশ্রাবক ধম্মসেনাপতি সারিপুত্র স্থবির যাঁর জন্ম নালন্দাতেই সারিচক নামে গ্রামে হয়েছিল। সেখানেই মহান সম্রাট অসোক দ্বারা চৈত্য (স্তূপ) এবং বিহার স্থাপন করা হয়েছিল, যাহা পরবর্তীতে এসে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়রূপে প্রসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে। সে সারিপুত্র এবং সম্রাট অসোক মহানেরও কোনো প্রতীক চিহ্ন সেখানে অঙ্কন করা হয়নি।ভারতের যশশ্বী প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী যখন বহির্বিশ্বে গিয়ে থাকেন, তখন উচ্চস্বরে গলা ফাটিয়ে প্রচার করতে থাকেন যে-‘আমি বুদ্ধের দেশ হতে এসেছি।’ কিন্তু বুদ্ধের সিদ্ধান্তের উপর চলা নালন্দার ভূমিতে আসতে আপনার লজ্জা-উৎপন্ন হয়েছে দেখা যায়না। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর জন্য শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন বিদ্বান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং মহোদয়। উদ্বোধন করার পূর্বে মোদীজীর কাছে কি সূচনা পৌঁছুয়নি যে, এখানকার পরিসর হতে ভগবান বুদ্ধের মূর্তি গায়েব করা হয়েছে? প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তির সূচনা মৌর্যকাল হতে হয়ে পাল বংশের সময়ে এসে মহীরূহ আকার ধারণ করেছিল। গুপ্তবংশের রাজাগণ, সম্রাট হর্ষবর্ধন এবং পাল বংশের রাজাগণের দ্বারা সংরক্ষণ ও সংবর্ধন করা হয়েছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধ দর্শনের সাথে সাথে অন্যান্য আরও অনেক বিষয়ে অধ্যয়ন চালু ছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান দার্শনিক নাগার্জুন, পাতঞ্জলি, আর্যভট্ট, রাহুল শ্রীধর, হিউয়েন সাংয়ের মত আচার্যগণ নিজেদের সেবা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিমা সমগ্র বিশ্বে প্রসারিত করা হয়েছে। বর্তমান সময়ের সংবেদনহীন সরকার দ্বারা এজেন্সীর মাধ্যমে নির্মাণ কার্য চলাকালে পরিসরে তথাগত ভগবান বুদ্ধের মূর্তি, তাঁর অগ্রশ্রাবক সারিপুত্র ও মহামোগ্গল্লায়ন স্থবিরের মূর্তি ও সম্রাট অসোক মহানের মূর্তি স্থাপন না করা হল ভারতীয় ইতিহাস এবং সংস্কৃতির ঘোর অপমান। এরকম কুকৃত্যের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি বা এজেন্সিকে চিহ্নিত করে দণ্ডিত করার প্রয়োজন রয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে কেহ এরকম ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সাথে ছেলেখেলা করার সাহস না পায়।